বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে বহু মানুষ বাংলাদেশে ঢুকে পড়ায় উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। গত এক মাসে শুধু ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর সীমান্ত থেকে তিন শতাধিক মানুষকে আটক করেছে বিজিবি।
তবে স্থানীয় লোকজন বলছেন, যে সংখ্যায় মানুষ আটক হচ্ছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষ প্রতিদিন বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি জানার চেষ্টা করেছে এদের পরিচয় কী এবং কেন এই অনুপ্রবেশ?
গত ৯ই ডিসেম্বর রাতে মহেশপুর সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার সময় ৫৮ বিজিবি সদস্যদের হাতে আটক হয় ১২ জন। এর মধ্যে রবু নামের একজন ছোট ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। সপরিবারে থাকতেন ভারতের মুম্বাই শহরে।
তার দাবি, ভাল কাজের সুযোগ পেতে বাংলাদেশ থেকে তিনি কয়েক বছর আগে ভারতে গিয়েছিলেন। অবৈধ নাগরিক হিসেবে আটক হয়ে তার স্ত্রী ছ’মাস ধরে এখন ভারতের কারাগারে রয়েছেন। আসামে ‘মুসলিম বিরোধী’ আইন নিয়ে কেন উত্তেজনা
“ওখানে ধরা পড়ে যাচ্ছে, বাঙালিগে ধরায় দিচ্ছে, রাখতি চাচ্ছে না। এজন্য মানুষজন ওদেশে থাকতি চায় না কেউ। ওদেশে যে কামাই এদেশেও সেই কামাই। এদেশেও এহন রুজি রোজগার করে খাওয়া যাবে,” বলছেন রবু।
দুই সন্তান নিয়ে আটক হয়েছেন রাবেয়া হাওলাদার। আট বছর ধরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পুরো পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন।
তার ছেলের জন্ম হয়েছে ভারতে। বাংলাদেশে নড়াইল জেলার কালিয়াতে তার বাড়ি বলে দাবি করলেন।
স্বেচ্ছায় এসেছেন নাকি কেউ আসতে বাধ্য করেছে এ প্রশ্নে রাবেয়া বলেন, “আমি নিজের ইচ্ছায় চলে আসছি। এখন সবকিছু হয়ে গেছে। এখানে বাড়ি করেছি। স্বামীকে বিদেশে পাঠিয়েছি।”
বিজিবি’র হাতে আটক ক্ষিতীশ বসু ভারতের নাগরিক। তার কাছে পাওয়া গেল ভারতীয় পরিচয়পত্র। পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস ভারতের নদীয়া জেলায়।
তার দাবি, ১৯৮৮ সালে তিনি দেশান্তরী হয়েছেন বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ থেকে। এবার অসুস্থ ভাইকে দেখতে এসেছেন অবৈধ পথে। “এখানে আসছি বেড়াতে। বেড়ায়ে আবার চলে যাব। ওখানে আমার পরিবার আছে, ছেলে, মেয়ে আছে।”
বিজিবি সূত্র জানাচ্ছে, এরা অনুপ্রবেশকারী। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মহেশপুর সীমান্ত থেকে ৪৭ জনকে আটক করা হয়েছে। তবে সীমান্তবর্তী গ্রামে ঘুরে জানা যায়, এরকম প্রতিদিনই বহু মানুষ ঢুকছে যাদের ধরা যাচ্ছে না।
সীমান্তবর্তী এলাকার নেপা বাজারে এমন একজনকে পাওয়া গেল যার পরিচয় উদ্ঘাটনে ভিড় জমিয়েছে স্থানীয় গ্রামবাসী। তার দাবি, ভারতে দালালকে ১০ হাজার রুপি দিয়ে তিনি বাংলাদেশে ঢুকেছেন।
বাংলাদেশে ঢোকার পর এপারের দালালরা তার মোবাইল ও টাকাপয়সা সব ছিনিয়ে নিয়েছেন বলে তিনি জানালেন। সবুজ নামের ওই তরুণ জানান তিনি ব্যাঙ্গালুরু থেকে এসেছেন।
আট-নয় মাস আগে কাজের সন্ধানে তিনি ভারতে গিয়েছিলেন। তার মতো আরো অনেকেই ১০ই ডিসেম্বর রাতে সীমান্ত পার হয়েছেন। কিন্তু ঐ দিন বিজিবির হাতে কেউ আটক হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
“আমরা একসাথে ঢুকছি চারজন। অন্য লাইনেও দেখছি ঢুকতে। পঞ্চাশ জনের মতো,” বলেন সবুজ।
মহেশপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষের কথায় পরিস্থিতি অস্বাভাবিক, এবং আগে কখনোই ভারত থেকে এরকম মানুষকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেখেননি তারা।
সীমান্তবর্তী নেপা ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি বাবু শেখ বলেন, প্রতিদিনই মানুষ ঢুকছে। একশ্রেণীর দালাল চক্র এখন খুবই তৎপর বলেও তিনি দাবি করেন।
“পঞ্চাশ-একশ প্রত্যেক দিনই আসতেছে। এ এলাকারই লোকজন আছে তারাই শেল্টার দেয়,” বলছেন তিনি, “এজন্যই মনে করেন, আমাদের আইনরক্ষকরা ব্যর্থ হয়। কারণ এদের ধরার জন্য বিজিবি বসে থাকে,আর বিজিবিকে পাহারা দেয়ার জন্য থাকে আমাদের লোকজন।”
মহেশপুর সীমান্তে অনুপ্রবেশের বিষয়টি শুরু থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন স্থানীয় সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী আব্দুর রহমান।
বিজিবির হাতে আটক অনেকের সঙ্গেই তার কথা হয়েছে। তিনি বলেন, এমন অনেকেও এসেছে যারা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ভারতে বসবাস করছিলেন।
“যারা ধরা পড়ছে তার তিনগুণ বেশি ধরা পড়েনি। তারা যে বর্ণনা দিচ্ছে তাদের নাম ঠিকানায় যা জানা যাচ্ছে তারা বেশিরভাগই মুসলিম। তারা আতঙ্কগ্রস্ত। এবং আমার যেটা মনে হচ্ছে যে ভারতের এনআরসির প্রভাবেই তারা এখন সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে ফিরে আসছে।”
“আমরা যেটা খবর পাচ্ছি আমাদের সোর্সের মাধ্যমে সেটা হচ্ছে যে বিএসএফ এই সমস্ত মানুষদের বর্ডার ক্রস করার জন্য সহযোগিতাও করছে।”
ভারত থেকে বাংলাদেশে গোপনে জোরপূর্বক ”পুশব্যাক” চলছে এমন অভিযোগ নিয়ে ভারতের মানবাধিকার কর্মীরাই সোচ্চার হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে।
বাংলাদেশে সীমান্তবর্তী অন্যান্য জেলায় অনুপ্রবেশের খবর আসছে। মাঠ পর্যায়ে বিজিবি এসব তথ্য জানালেও আনুষ্ঠানিকভাবে তারা কোনো কথাই বলতে রাজি না।
বিজিবি সদরদপ্তরে যোগাযোগ করেও এ নিয়ে কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। স্থানীয় প্রশাসনও বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। ওদিকে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বিবিসিকে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। এবং সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।-বিবিসি